মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৩৩ পূর্বাহ্ন

মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়ের ঐ ক’ মাসের ঋণ মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে শোধ করবে ?

  • আপডেট : শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০২৩

মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়ের ঐ ক’ মাসের ঋণ মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে শোধ করবে ?

মে মাসের কোন এক দিন (তারিখ মনে নেই) পরন্ত বিকেলে ১০/১২ জনের একটি দল আমাদের বাড়িতে এসে বাবাকে ডাকছে ও ওমর সরকার! বাড়ি আছেন ? জোড়ে জোড়ে দু,তিনটি ডাক চিৎকার করতে লাগলেন। আমি আমার বড় বোন (০৮)ও ছোট ভাই (০৩) আমার বয়স ০৬/০৭ বছর। তিনজন এক দৌড়ে বাড়ীর বাইরে বাড়ি চলে এসে দেখি লোকগুলো কি যেন বলা বলি করছে ? একজন এগিয়ে এসে আমাকে বলল- এই ছেলে সরকার সাব কি হয় তোমার ? ওনি বাড়ি আছেন ? ওনাকে ডেকে দাওতো বাপু ? আমি বললাম – আমার বাবা, উনি বাড়ির ভিতরে আছেন? আর একজন বলল- ডেকে আনোতো তোমার বাবকে ? আমি ভয় পেয়ে কি করব বুঝে উঠতে পারছি না ? ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ভাবছি একজন বলল তুমি ভয় পাচ্ছ কেন ? তোমার বাবাকে ডেকে আন কথা আছে । এক দৌড়ে বাড়ীর ভিতর গিয়ে বাবার কাছে গিয়ে বললাম- বাবা ! বাবা ! ১০/১২জন লোক আ্ইছে আপনাকে ডাকে ? বাবা কি যেন ভাবলেন তার পর বাইরে বেড়িয়ে এলেন। সালাম দিয়ে বাবা বললেন আপনারা আমার বাড়ীতে ! হাঁ সরকার সাব আমরা আসছি আপনার বাড়ীতে একটি বিশেষ কাজে। আমরা মুক্তিযোদ্ধা, আপনার বাড়ীটি ছেড়ে দিতে হবে ? আমরা আপনার বাড়ীতে গোলা-বারুদ ও খাদ্য রাখব, গোডাউন বানাবো। বাবাতো হতবাক হয়ে চোখে শরষের ফুল দেখতে লাগলেন , বললেন- আমরা বাড়ি ছেড়ে যাব কোথায় ? তাছাড়া আমার স্ত্রী অসুস্থ্য ৯ মাসের গর্ভবতি বাচ্চা কাচ্চারা সবাই ছোট, গরু ছাগলসহ অনেক জিনিস রয়েছে এগুলো ছেড়ে কি ভাবে যাব ? বড় মুছ ওয়ালা খাটো একজন এগিয়ে এসে বলল দেখেন সরকার সাব আমাদের এত কথা বলার সময় নেই । কাল সকালে এসে যেন বাড়ি খালি পাই, নইলে আমরা খালি করে নিব। আমরা খালি করলে কিন্তু কিছু পবেন না ? বাবা কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন আমাকে একটু ভাবতে দেন, একটু সময় দেন-আমার শিশু সন্তানদের দিকে তাকিয়ে বলুন এদের নিয়ে কোথায় যাব ? একজন কড়া ভাষায় শাশিয়ে বললেন আপিনি বেশি কথা বলছেন সরকার সাব। সময় দেয়ার মত সময় আমাদের নেই। আমরা চলে গেলাম সকালে আসব ।
বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন, কি করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। এমন বিপদ থেকে কে বাঁচাবে ? আল্লাহ রক্ষা করো, আমাদের, এই বলে একবার আমাদের দিকে তাকায় বাবা, আমরা বাবার দিকে তাকাই, বাবার চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে। আমরাও বাবার চোখের পানি দেখে সবই কান্না করছি। বাবাকে আমি বললাম বাবা ওরা কারা ? আমাদের বাড়ী ছাড়তে বলে- বাবা বলল তোরা জানিস না ওরা মুক্তিবাহিনী। ওদেরকে ঘর ছেড়ে দিতে হবে ? চল বাড়ীর ভিতরে । সকল কিছু গোছাইয়ে নিতে হবে ? রাতেই যার যার কাপড় চোপড় গোছিয়ে রাখলাম। ভোরে মোয়াজ্জিনের আজানের সাথে সাথে ঘুম থেকে উঠে সকলে চললাম অজানার পথে, কোথায় যাব কিছুই জানি না। বেড়ীখোলা তারাকুড়ী জঙ্গলের ভিতরে বাবা আমাদের নিয়ে গেলেন এক বাড়িতে। মুক্তিযোদ্ধা শাসছুদ্দোহার বাড়ীর পাশে জাস ভাইদের বাড়ী এটি । একটি টিনের ঘর, পাঠখুড়ির বেড়া। পাকের ঘর ছোট একটি । জাস ভাই আমাদের বাড়ীতে দু বছর কামলা ছিল । বাবাকে দেখে খুশিই হল । বাবা বলল- জাস বাড়ী ছেড়ে তোমাদের বাড়ীতে এলাম সকলকে নিয়ে যোদ্ধ যতদিন থাকবে ততদিন থাকতে হবে । বাড়ী থেকে কিছুই আনতে পারি নাই। কিছু চাল ডাল আছে। আমরা চার ভাই বোন। জাস ভাইর দুই মেয়ে ৩ – ৫ বছরের। একটি মাত্র ঘর গাধাগাদি করে থাকতে হবে। মা অসুস্থ্য। এক বেলা খাইলে আর সারা দিন খাওয়া হয় না। বাড়ীতে গরু ছাগল গোয়াল ঘরে রেখে আসছি। গরু ছাগলগুলোও দু একদিন পর পর খাবার দিয়ে চলে আসি। বাড়ীতে বিভিন্ন ফলের গাছ রয়েছে ৬/৭ দিন পর পর এসে ছিড়ে নিয়ে যাই। বাড়ী থেকে ২ কি . মিটার দূর।
বাড়ীতে না থেকে সব সময় চিন্তায় থাকতে হয়। মাঝে মাঝে গোলাগুলির শব্দ শুনে চিৎকার করে উঠি। মাটির নিচে গিয়ে লুকাই আমরা। উঠানে ৫/৬ হাত গর্ত করে কুপ খনন করে কুপের ভিতর খরকুটা বিছিয়ে রাত কাটাই। জঙ্গলের একবারে নিকটে বিধায় রাত হলেই শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক-চিৎকার শুনে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পড়ি সবাই। এর মাঝে ১ মাস কেটে গেল ।
এল এক ভয়াবহ রাত। শুনলাম বল্লা বিহারীরা রেট করেছে ওরা পূর্ব দিক দিয়ে আসবে। আমরা আরো ভয় পেতে লাগলাম। রাত দুইটার দিকে মায়ের কান্নায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। মা কান্না করছে জোড়ে জোড়ে, মারা গেলাম, আমাকে বাঁচাও। মায়ের প্রসব বেদনা উঠছে ?

কান্না শুনে গর্ত থেকে বেড়িয়ে এলাম আমরা তিনজন। বাবা বলল-বুকে (বুঝি) তাড়াতাড়ি ডেকে নিয়ে আয় জলদি যা- বাবা ভাই ও আমাকে বলল। ১ কি. মি. দূরে ফুফু থাকে আরেক বাড়িতে। পাঠ খুড়িতে আগুন ধরিয়ে ছুটলাম আমি ভাই ও জাস ভাই ফুফুকে আনতে, ফুফু দাইয়ের কাজ জানে। রাস্তা চিনিনা রাতের বেলা আগুনে ভাল ভাবে দেখাও যায় না, এমনিতে ঘুমঘুম ভাব, ভয়ও করছে, কয়েক জায়গায় উষ্টা খেয়ে পড়ে গেলাম আমি। ভাই আমার হাত ধরে। আমরা ঐ বাড়িতে গিয়ে ফুফুকে নিয়ে আসলাম রাত ৩টায়।
ফুফুকে ঘরে ডুকিয়ে দিয়ে আমরা ঐ গর্তে বসে রইলাম। ১ ঘন্টা পর ফুফু বলল- তোরা আমাকে কিছুক্ষণ আগে আনলে বাচ্চাটা বাঁচাতে পারতাম। মরা মেয়ে বাচ্চা হইছে । মা তখনও অচেতন মায়ের অবস্থা ভাল নয়। হাসপাতাল, ডাক্তার পাব কোথায়। সব ভাই বোন এক সাথে কান্না করছি আর আল্লাহকে ডাকছি, বাবা দিক বিদিক ছুটাছুটি করছে। এর মধ্যে ফুফু বাইরে বেড়িয়ে বলল- তোরা কান্দিস না তোদের মায়ের জ্ঞান ফিরছে । আমরা দৌড়ে ঘড়ে গিয়ে মাকে ডাকলাম। মা উত্তর নিল। আমরা খুশিতে সবাই আল্লাহকে ডাকলাম।
ভোর হয়ে এল। ফজরের নামাজ সেরে বাবা সকলকে বলল, বাচ্চাটার সৎকার করতে হবে। ওকে গোসল করিয়ে কাফন পড়িয়ে নিয়ে চললাম আমাদের বাড়ীতে। আমাদের পারিবারিক গোরস্থানে তাকে মাটি দিয়ে সকলে আবার জঙ্গলে চলে এলাম।
যুদ্ধ চলছে থামে না আমরাও বাড়িতে যেতে পারছিনা। এ দিকে সময় পার হয়ে ছয় মাস কেটে গেল বাড়ীর সকল ফসল মুক্তি বাহিনী খেয়ে ফেলেছে। গরু ছাগল সব খেয়ে ফেলেছে। বাড়ীর যত ফল, সরবিকলাসহ অন্যান্য ফসলও খেয়েছে। মাঝে মাঝে সকালে চলে আসি বাড়ীতে, নিজেদের বাড়ী, তাও আবার ওদের অনুমতি নিয়ে। নিজেদের সকল কিছু সবই আছে কিন্তু আমরা থাকি পরের ঘরে। কতই না কষ্টে কাটছে আমাদের সময়। কি বলব, বাবাকে বলি- আর কতদিন আমাদের এখানে কাটাতে হবে ? বাবা বলে দেশ স্বাধীন হবে ? এদেশ স্বাধীন হলে আমাদের অনেক লাভ হবে। স্বাধীন কী বাবা? বাবা বলে আমাদের দেশ স্বাধীন হলে আমরা চাকরি বাকরি করে ধনী হতে পাড়ব। তোমরা লেখা পড়া করে চাকুরী করবে তাহলেই আমাদের অভাব আর থাকবে না। দু:খ কষ্টও থাকবে না। বাবা আমাদের গরু ছাগল বেটারা খাইছে কেন? ওরা তো খাবেই না খাইলে কিভাবে যুদ্ধ করবে ? বাবা বলে- ওরা দেশটা স্বাধীন করলেই আমরা লাভবান হবো।
আজ ২৬ই মার্চ স্বাধীনতা দিবস। দেশ এখন স্বাধীন। জাতী স্বাধীনতার ৫৩ বছর পুর্তি অনুষ্ঠান করছে বাঙালীজাতী।। আমি ভাবছি আমার ঐ বোনটি এখন বেঁচে থাকলে ৫৩ বছর বয়স হতো। আমার বড় বোন জুড়িয়া ৮ বছর হয় মারা গেছে। ওর ক্যান্সার হয়েছিল। আমার আর এক বোন জুলেখা ডিগ্রী পরীক্ষার্থী ছিল। সেও মারা গেছে দুই কিডনি ফেলর হয়ে। আজ আমরা তিন বোন ছাড়া, ৫ ভাই বেঁেচ আছি। বাবাও মারা গেছে ৮ বছর হলো। মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের এ কয় মাস জায়গা দিয়ে গরু ছাগলসহ সকল কিছুই খোয়া গেছে আমাদের। দেশও স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমাদের জীবনের ঐ ক’ মাসে যা হারিয়েছি আমরা, যে অসহনীয় যন্ত্রনাময় জালাতন সহ্য করে কাটায়েছি ঐ দিনগুলো আমরা । মাটির গর্তে খড়কুেটা বিছিয়ে এ কয় মাস কাটানোর মূল্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণ কিভাবে শোধ করবে? কতজন মুক্তিযুদ্ধের সময় ডোলের মধ্যে পালিয়ে থেকে বড় মুক্তিযোদ্ধা সেজেছে। তাদের বাচ্চা কাচ্চারা মুক্তিযোদ্ধার কোটায় চাকরি করে। অথচ মুক্তিযোদ্ধাদের যারা আশ্রয় প্রশ্চয় দিয়েছে তাদের কোন মূল্যায়ন বাংলার মাটিতে হয়ে উঠছে না। আমার বাবা মরহুম আলহাজ ওমর আলী সরকার বাড়ী ঘর ছেড়ে না দিলে, মুক্তিযোদ্ধাদের জায়গা না দিলে, দেশের স্বাধীনতা আসতো কিভাবে? মুক্তিযোদ্ধাদের ইতিহাস রচনাকারী ঐতিহাসিকগণ কি আমাদের বাড়ীর গোডাউনের কথা ভুলে গেছেন ? ওই সময়ের লেখকগণ যে বই লিখেছেন সে বইয়ে আমাদের বাড়ির গোডাউনের কথা লেখেন নাই। মৃত আলহাজ ওমর আলী সরকারকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ঘোষনা করলে হয়ত তার উপর ঐ কয় মাসের এই জুলুমের মূল্যায়ন হত। মুক্তিযোদ্ধাদের কতই না মূল্য এখন। বাবা বলছিল- দেশ স্বাধীন হলে আমরা লাভবান হবো ? কই আমরা তো লাভবান হতে পাড়লাম না ? তাইতো এখন প্রশ্ন করি, মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়ের ঐ ক’ মাসের ঋণ মুক্তিযোদ্ধারা কীভাবে শোধ করবে ?

লেখক: সাংবাদিক
মো: আ: লতিফ মিঞা
সহকারী শিক্ষক
মহানন্দপুর বিজয় স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়
সখিপুর,টাঙ্গাইল।

ফেসবুকে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটেগরির আরো খবর

Office : Sakhipur,Tangail,Bngkadesh. Mobile : 01717338188

Email : acottorerronangon@gmail.com

© All rights reserved © 2021 Ten Theme